প্রকাশিত: ০২/০৯/২০১৫ ৯:১৯ অপরাহ্ণ
গণতন্ত্র দুই-একবার আলোর মুখ দেখলেও নিভে যেতে সময় লাগেনি

2_103751
তুষার কণা খোন্দকার:
বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মের পর থেকে তার আঙ্গিনায় গণতন্ত্র চর্চার পথ কিছুতেই নিষ্কণ্টক হচ্ছে না। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে পথ চলা শুরু করার পর থেকে গণতন্ত্র দুই-একবার আলোর মুখ দেখলেও সেটি নিভে যেতে বেশি সময় লাগেনি। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে গণতন্ত্রের অপমৃত্যুকে বারবার স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নিতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ের সংকট নিয়ে ভাবতে গেলে মনে হচ্ছে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সঙ্কুুচিত হয়ে আসছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে প্রকাশ্যে নরক গুলজার করে নিয়েছে। চাঁদার জন্য স্কুলের বাচ্চাদের মেরে হাসপাতালে পাঠাতে তাদের বুক কাঁপছে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশে গণতন্ত্র এবং পরমতসহিষ্ণুতার অস্তিত্ব আছে বলে ঢাক পিটিয়ে শেষ রক্ষা হবে না তার প্রমাণ বাংলাদেশে অনেকবার পাওয়া গেছে। তবুও রাজনীতিকরা কেন বারবার ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন সেটি এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ধারাবাহিকতায় বারবার ছেদ পড়তে দেখে সচেতন মানুষের মনে আক্ষেপ জাগে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এমন অপমৃত্যু হওয়ার কথা ছিল না। কারণ বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম হয়েছে বাঙালির গণতন্ত্র পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে। স্বাধীনতা লাভের দাবি নিয়ে বাংলাদেশে কোনো গণআন্দোলন হয়নি, গণতন্ত্রের দাবি আদায়ের প্রশ্নে আমরা অবিচল ছিলাম বলে তার পরিণাম হিসেবে আমাদেরকে যুদ্ধে যেতে হয়েছে। এই একটি প্রশ্নে পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা অনন্য। পৃথিবীর যে প্রান্তে যখন কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সশস্ত্র অথবা নিরস্ত্র আন্দোলন হয়েছে সেসব আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল নিজেদের দেশকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করা। বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার জন্ম দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দুই দশক ধরে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার ছিল। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করেছে। সে সময়ে পাকিস্তানের মিলিটারি এবং সিভিল আমলারা কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেশবাসীকে গণতন্ত্র দিতে পারেনি। কায়েমি শাসকরা হিংস্রভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতা অাঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের গণতন্ত্রের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দিয়েছিল, তখনো রাজনৈতিক আঙিনায় স্বাধীনতার দাবি ওঠেনি। ১৯৭১ সালের আগে বাঙালি স্বাধীনতা চেয়েছে বলে ইতিহাসে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। স্বাধীন হওয়ার পরে সময় নষ্ট না করে সে সময় ক্ষমতাসীন ভারতীয় কংগ্রেস শাসনতন্ত্র রচনা করে ভারতে পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করেছিল। অথচ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে পাকিস্তান গণতন্ত্রের পথে এক পা সামনে বাড়েনি। পাকিস্তান জন্মের পরদিনই পাকিস্তান প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পথে পা বাড়িয়েছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে মত্ত না হয়ে পাকিস্তান যদি ভারতের আদলে শাসনতন্ত্র রচনা করে তার আওতায় গণতন্ত্র চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারত তাহলে বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হতো বলে আমি মনে করি না। পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চা হয়নি বলে মুসলিম লীগের এক অংশ যারা পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে সক্রিয় ছিল তারাই আওয়ামী লীগ নামে নতুন দল সৃষ্টি করেছিল। মুসলিম লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল না। মুসলিম লীগের যে অংশ আওয়ামী লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় দেশবাসীর সামনে নিশ্চিত করেছিল। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ শাসকরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল থাকলে পাকিস্তানের ক্ষমতায় কে আসত কে যেত সেটি বলা মুশকিল, তবে গণতান্ত্রিক পাকিস্তানে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের জন্ম হতো না এ কথা নিশ্চিত করে বলা চলে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে বলা যায়, পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরে বাংলাদেশ নামে একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটানোর জন্য আন্দোলন শুরু করেনি। আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। পাকিস্তানের মিলিটারি শাসকরা ‘৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের দেওয়া রায় মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে এদেশে রক্তাক্ত একাত্তরের জন্ম হতো না। পাকিস্তানের মিলিটারি শাসকরা জনগণের ইচ্ছাকে বাতিল করে দিয়ে বুলেটের ঘায়ে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আমরা বাঙালি বুলেটের জবাবে পাল্টা বুলেট ছুড়ে দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি, কিন্তু বুলেটের সামনে নতজানু হয়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসন মেনে নেইনি। বর্তমান অসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন প্রজন্ম কি কুহকে মেতে উঠেছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না বলে তাদের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির বাস্তবতা জানাতে চাচ্ছি। নতুন প্রজন্মের এক অংশ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে হাতিয়ার বানিয়ে পরমত দমনের কাজে মেতে উঠেছে। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পরমত দমনে মেতে উঠলে দেশে চিরস্থায়ী আওয়ামী রাজ কায়েম হয়ে যাবে। তরুণ সমাজের যে অংশ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিকে গণতন্ত্র হত্যার হাতিয়ারে পরিণত করেছে তাদের জানতে হবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান গণতন্ত্রের দাবির ন্যায্যতা তুলে ধরত। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছিল বলে সেটি স্বাধীনতার ধ্বনি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছিলেন না। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকার পরেও তারা যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেতভাবে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ব্যবহার করেছেন কারণ তারা জানতেন ‘জয় বাংলা’ স্বাধিকার এবং গণতন্ত্রের পক্ষে বারবার উচ্চারিত হয়ে সেটি বাংলাদেশের সব মানুষের ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে বিচার করলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না। যে কোনো দেশের মূল জাতির পাশাপাশি যেসব উপজাতি এই মাটির সন্তান তাদের নিজস্ব উপজাতীয় বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি যেটাকে তারা আমাদের মতোই ভালোবাসে বুক দিয়ে সে বৈশিষ্ট্য আগলে রাখে। অথচ আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তারাও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ভিন্ন কোনো ভাবনা মনে জায়গা দেয়নি। গণতন্ত্র, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার মর্মবাণী হিসেবে তারা ‘জয় বাংলা’ বলতে দ্বিধা করেনি। তারা জানত, একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের, ভিন্ন মত ও পথের মানুষকে এক কাতারে একাট্টা হয়ে দাঁড়াতে হয়। সর্বজনের মতৈক্যের পক্ষে সেখানে একটি ধ্বনি উচ্চারিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আওয়ামী লীগের ধ্বনি হিসেবে সৃষ্টি হলেও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এটি সর্বজনীন রূপ পেয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির যেমন ভয়াবহ অপব্যবহার শুরু হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে এটি করুণ পরিণতির দিকে চলে গেলেও আমি অবাক হব না।

ভাষাতত্ত্বের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন, শব্দ কোনো দিন এক অর্থে এক উচ্চারণে অবিকল থাকে না। মধ্যযুগে ভালো অর্থে ব্যবহৃত অনেক শব্দ এখন নিন্দা অর্থে ব্যবহার হয়। আবার এককালে ভালো অর্থে ব্যবহার হতো এমন অনেক শব্দ এখন ভয়ঙ্কর গালিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নাজি শব্দটি শোনার পরে কেউ ভাবে না এটি ন্যাশনাল সোস্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির শব্দ সংক্ষেপ। চরম অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে দুনিয়াজোড়া সব মানুষের চোখে শব্দটি মূর্তিমান আতঙ্ক। ‘৭১ সালে আমরা যারা অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়ে অন্তর থেকে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করেছি তারা আমাদের প্রিয় জয় বাংলা ধ্বনির অপমৃত্যু দেখতে চাই না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

পাঠকের মতামত

  • সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারকালে নারী ও শিশুসহ ১৮ জন রোহিঙ্গা উদ্ধার, এক দালাল আটক
  • বৌদ্ধ তারুণ্য সংগঠন- সম্যক এর ১৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন
  • টেকনাফে নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার
  • টেকনাফে পুলিশের অভিযানে ১৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার
  • কর্মক্ষেত্রে অনন্য কক্সবাজারের একমাত্র নারী ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন
  • টেকনাফে অর্ধডজন মামলার আসামি ডাকাত আবুল খায়েরসহ গ্রেপ্তার-২
  • ১৫ ঘন্টা পর ট্রলারসহ ৫৬ জেলেকে ছেড়ে দিয়েছে মিয়ানমারের নৌবাহিনী
  • চকরিয়ায় থানার সামনে সাংবাদিকের উপর হামলা
  • রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি হত্যা মামলার ৪ আসামী গ্রেফতার
  • বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ-ট্রাষ্ট পরিচালনা কমিটি গঠিত
  • সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারকালে নারী ও শিশুসহ ১৮ জন রোহিঙ্গা উদ্ধার, এক দালাল আটক

    সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারকালে নারী ও শিশুসহ ১৮ জন রোহিঙ্গা উদ্ধার, এক দালাল আটক

      আব্দুস সালাম, টেকনাফ:: সাগরপথে টেকনাফের বাহারছড়ায় মালয়েশিয়া পাচারকালে নারী ও শিশুসহ ১৮ জন রোহিঙ্গাকে ...